পাকিস্তানে তেমন কোন আলোচনা ছাড়াই এবার ১৬ ডিসেম্বর দিনটি পার হয়ে গেলো। আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটিকে স্মরণ করা হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম লাভের জন্য। এ দিনে ‘ঢাকার পতন’ পাকিস্তানের জন্য শুধু যন্ত্রণাদায়ক বিচ্ছেদ ও ভূখণ্ড হারানোর বিপর্যই শুধু নয়, এর রোমান্টিক স্মৃতিগুলোর মধ্যে গৌরবজনক মুসলিম অতীতের অংশটিও ফুটে উঠে।
বাংলাদেশে ১৬ ডিসেম্বর সরকারি ছুটির দিন ও বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভারতও দিনটিকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক জয় লাভের জন্য। আর পাকিস্তানে দিনটিকে স্মরণ করা হয় ইতিহাসের এই অধ্যায়টিকে ফিরে দেখা ও পূর্ব পাকিস্তানে তার ব্যর্থতার সম্ভাব্য কারণগুলো খুঁজে বের করার জন্য।
১৯৭১ সালের স্মৃতিটিকে জাগরুক রাখতে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি আধুনিক রাষ্ট্রেরই শহীদ, যুদ্ধস্মৃতি ও আখ্যান রয়েছে। এসব আখ্যানের জাতীয়তাবাদী ও যুদ্ধপ্রিয় সুরও রয়েছে, যা প্রকৃত সত্যের বিকৃতি ঘটায়। এসব আখ্যানে সংখ্যা (যুদ্ধের সময় কতজন মারা গেছে) ও যৌন সহিংসতার উপর নজর দেয়া হয়। এগুলো হয়তো ব্যবহার করা হয় প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য অথবা যুদ্ধ ও যুদ্ধের পর অফিসার ও সৈনিকদের সাহসিকতাকে মহিমান্বিত করার জন্য।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সিনেম্যাটিক চিত্রণ উপমহাদেশে যুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে সহায়ক হচ্ছে। যুদ্ধযন্ত্র নিয়েই পাকিস্তান ও ভারতের বেশিরভাগ সিনেমা তৈরি হয়। যেমন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় পানিসীমায় ডুবে যাওয়া সাবমেরিন পিএনএস গাজী নিয়ে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন টেলিফিল্ম ‘গাজী শহীদ’ তৈরি করে। এতে পাকিস্তানের গোপন ক্ষতির দিকটি তুলে ধরা হয়। একই ঘটনাকে ঘিরে ২০১৭ সালে বলিউডের ছবি ‘গাজী এ্যাটাক’-এ সাবমেরিন গাজী-কে ডুবিয়ে দিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর বীরত্বগাঁথা দেখানো হয়। ২০১৭ সালে সনিলাইভ-এর তৈরি ‘মুক্তি’ নামক আরেক শর্টফিল্মে দেখানো হয় ভারতীয় হামলায় পাকিস্তান নৌবাহিনীর অর্ধেক, বিমান বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ ও সেনাবাহিনীর এক-চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে; পাকিস্তানকেও দুই টুকরা করা হয়েছে। বর্ডার (১৯৭১), ১৬ ডিসেম্বর (২০০২), ১৯৭১ (২০০৭), ইত্যাদি এমন অনেক ছবির নাম করা যায়।
বাংলাদেশ তার দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী ১৯৭১ সালের উপর সিনেমা তৈরি করছে। অবশ্য এসব সিনেমার অনেকগুলোতে জনগণ-কেন্দ্রীক ও জনজীবনের উপর যুদ্ধের প্রভাব দেখানো হয়েছে, যেমন: ওরা ১১ জন (১৯৭২), মাটির ময়না (২০০২), গেরিলা (২০১১), আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১), ইত্যাদি।
এসব সিনেমায় ১৯৭১ সালকে কোননা কোনভাবে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়। কিন্তু ১৯৭১-এর জটিল সহিংসতার কারণে শুধু পূর্ব পাকিস্তানবাসীই নয় পশ্চিম পাকিস্তানীরাও যে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলো এগুলোতে তার উল্লেখ নেই। এসব সিনেমায় যুদ্ধবন্দিদের অভিজ্ঞতা অনুপস্থিত, তাদের পরিবারগুলোর দুর্দশার উল্লেখ নেই, নেই থরপারকারের হিন্দু, মুসলিম ও দলিতদের দুর্ভোগের কাহিনী- পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার মাইল দূরের মানুষের উপরও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিলো।
অন্যদিকে বাংলাদেশে কেউ যদি যুদ্ধটিকে ভারতের যুদ্ধ (যেমনটা ‘মুক্তি’তে দেখানো হয়েছে) হিসেবে তুলে ধরে তাকে পাকিস্তান-পন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে ১৯৭১ সালকে ব্যাপক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বুঝার বিষয়টি অনুপস্থিত। ১৯৭১ সালকে একটি দেশের বিজয় ও আরেকটির পরাজয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। দুই ধারার রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ও ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যে একে সীমিত রাখাও ঠিক হবে না।
পূর্ব পাকিস্তান ও এর আলাদা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে একাডেমিক উপকরণ অপর্যাপ্ত। পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে একাডেমিক, অটোবায়োগ্রাফিক ও আর্টিস্টিক আলোচনায় ১৯৭১ সালকে নিয়ে বক্রোক্তি করাই প্রাধান্য পায়।
পাকিস্তান পক্ষে ‘১৯৭১’ সালের আলোচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসারদের স্মৃতিকথা স্থান পায়, তাতে সংঘাতকে ঘিরে ভারতীয় বিবরণের পাল্টা যুক্তি দেয়া হয়।
এমন অনেক কাহিনী আছে যেগুলো শুধু ১৯৭১ সালকে বুঝতেই নয়, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো যুগ সম্পর্কে ধারণা তৈরিতে অবদান রাখতে পারে। এর জন্য আমাদের একাডেমিক সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের উপর সরকারি আর্কাইভটিকেও খুলে দেয়া প্রয়োজন।
লেখক: কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের এসিসট্যান্ট প্রফেসর
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-